কেনো ইরান রাতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে? তেহরানের কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত হিসাব-নিকাশ
.png)
রাতের নিস্তব্ধতায় যখন সাইরেন বাজে এবং ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো আকাশে আগত ক্ষেপণাস্ত্র গুলি থামাতে সচেষ্ট হয়, তখন একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে—ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলোর সময় নির্বাচনে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট কৌশল: অন্ধকার।
বারবার দেখা যাচ্ছে, ইরান রাতের অন্ধকারে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে। এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। বরং এটি একটি সচেতন সামরিক ও প্রযুক্তিগত নীতি—যার উদ্দেশ্য হলো গোপনীয়তা রক্ষা, শত্রুপক্ষকে চমকে দেওয়া এবং মানসিক ভীতির সৃষ্টি করা।
রাতের আড়ালে শুধু লুকিয়ে থাকা নয়—এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর কারণ
রাতের অন্ধকারে হামলার পেছনে সাধারণত দৃশ্যমানতা কম থাকাটাই মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে এটি শুধুমাত্র একটি দৃষ্টিনন্দন কৌশল নয়, বরং এটি একটি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, কৌশলগত প্রয়োজনে গৃহীত ব্যবস্থা এবং মানসিক যুদ্ধে ব্যবহৃত হাতিয়ার।
মুসলিম বিশ্ব রিলেটেড নিউজ
ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বিমান যেমন বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে তা পারে না। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে নিজস্ব জ্বালানি এবং অক্সিডাইজার বহন করতে হয়—যাতে উচ্চমাত্রার উত্তপ্ত দহন সম্ভব হয়। কারণ, বলিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অনেক উচ্চতায় ওঠে, যেখানে বাতাস বা অক্সিজেন প্রায় অনুপস্থিত।
ক্ষেপণাস্ত্র দুই রকম—তরল জ্বালানি এবং কঠিন জ্বালানি
🔶 তরল জ্বালানি: শক্তিশালী কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ
ইরানের অনেক দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যেমন শাহাব সিরিজ সাধারণত তরল জ্বালানির উপর নির্ভরশীল। এগুলো চালু করার জন্য একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়—দুটি পৃথক ট্যাংকে জ্বালানি ও অক্সিডাইজার রাখা হয় এবং তা নিক্ষেপের আগে একত্রিত করতে হয়।
এই পুরো প্রস্তুতি প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং স্থির লঞ্চ স্টেশনের প্রয়োজন হয়। ফলে, এই সময়েই ক্ষেপণাস্ত্র সবচেয়ে দুর্বল থাকে—বিশেষ করে উপগ্রহ ও ড্রোন নজরদারির অধীনে। এই ঝুঁকি এড়াতে ইরান সাধারণত রাতের বেলা এই প্রস্তুতি ও লঞ্চ সম্পন্ন করে, যাতে শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
🔷 কঠিন জ্বালানি: মোবাইল ও প্রস্তুত
অন্যদিকে, ইরানের স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যেমন ফাতেহ-১১০ এবং জুলফিকার সাধারণত কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রি-লোডেড অবস্থায় থাকে—অর্থাৎ এতে আগে থেকেই জ্বালানি ও অক্সিডাইজার মিশ্রিত কঠিন পদার্থ হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। ফলে এগুলো যে কোনো সময় মোবাইল প্ল্যাটফর্ম থেকে ছোড়া সম্ভব।
তবে একবার চালু হলে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব নয়—এটি একটি অপারেশনাল ঝুঁকি হলেও, গতিশীলতা ও আকস্মিকতার জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর।
ক্ষেপণাস্ত্রে অক্সিজেন বহনের প্রয়োজন কেন?
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন ক্ষেপণাস্ত্রে নিজস্ব অক্সিজেন থাকতে হবে? এর কারণ হলো, ক্ষেপণাস্ত্র এমন উচ্চতায় যায় যেখানে অক্সিজেন থাকে না। ফলে টার্গেটে পৌঁছাতে নিজস্ব অক্সিডাইজার ছাড়া ক্ষেপণাস্ত্র এগোতে পারে না।
প্রযুক্তি ও কৌশলের সম্মিলিত ফল
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নীতি একটি সুপরিকল্পিত সামরিক কৌশলের ফসল, যেখানে প্রযুক্তি, গোপনতা, গতি ও মানসিক প্রভাব সব কিছুরই বিবেচনা রয়েছে।
তরল ও কঠিন উভয় ধরনের জ্বালানির ব্যবহার, মোবাইল লঞ্চ সিস্টেম এবং রাতের প্রাকৃতিক অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে ইরান একটি এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যা টিকে থাকার, আকস্মিকভাবে আঘাত করার এবং শত্রুপক্ষের উপর মানসিক প্রভাব ফেলার ক্ষমতা রাখে—even যদি ক্ষেপণাস্ত্র নিজেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেবল ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বা শক্তিই গুরুত্বপূর্ণ নয়—তা কখন, কীভাবে, কোন পরিবেশে ছোড়া হয়, তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
🖊️ রিপোর্ট অনুবাদ ও সম্পাদনা: মুক্তধ্বনি ডেস্ক
📌 সূত্র: Jerusalem Post / Reuters
মু্ক্তধ্বনি অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন